বাংলাদেশের মঞ্চে আর্থার মিলারের নাটক ডেথ অব এ সেলসম্যান


বাংলাদেশের মঞ্চে আর্থার মিলারের নাটক ডেথ অব এ সেলসম্যান

বাংলাদেশের মঞ্চে আর্থার মিলারের অত্যন্ত জনপ্রিয় নাটক ডেথ অব এ সেলসম্যান নিয়ে এসেছে নাটকের দল থিয়েটারিয়ান।

থিয়েটারিয়ানের প্রথম প্রযোজনা ডেথ অব এ সেলসম্যান। এই নাটকে তুলে ধরা হয়েছে পুঁজিবাদী সমাজে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের জীবন সংগ্রাম, সম্পর্কের টানাপোড়ন এবং স্বপ্ন ভাঙার গল্প।

ঢাকার বেইলি রোডে ২২ এপ্রিল ২০২২ মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে থিয়েটারিয়ান প্রথম বার মঞ্চে নাটকটি নিয়ে আসে। নাটকের দ্বিতীয় প্রদর্শনী হয় একই জায়গায় ২৩ এপ্রিল।



নাটকের কথা

আর্থার মিলারের নাটক ডেথ অব এ সেলসম্যান পরিচয় হারানো এবং একজন মানুষের নিজের এবং সমাজের মধ্যে পরিবর্তনকে মেনে নেবার অক্ষমতাকে সম্বোধন করে আবর্তিত । নাটকটি স্মৃতি, স্বপ্ন, দ্বন্দ্ব এবং তর্কের একটি মিশ্র ছবি, যা সবই উইলি লোম্যানের জীবনের শেষ ২৪ ঘন্টা বর্ননা করে। একজন ব্যর্থ বিক্রয়কর্মী যিনি আমেরিকান স্বপ্ন এবং কাজের নীতি সম্পর্কে বিকৃত ধারণা পেয়েছিলেন। নাটকটি তার স্ত্রী, তার ছেলে এবং তার পরিচিতদের সাথে তার সম্পর্কও অন্বেষণ করে।

উইলি লোম্যান চরিত্রটি যেন বলে মধ্যবিত্ত আমেরিকানদের জীবনের গল্প। সামান্য সেলসম্যানের চাকরি করে উইলি, সামান্যই করতে পারে নিজের পরিবারের জন্য। স্বপ্ন তার স্ত্রীকে স্বাধীন জীবনযাপনের সুযোগ করে দেওয়া, বাচ্চাদের জন্য চায় সে প্রাচুর্য আর সফলতা। কিন্তু সে সফলতার দেখা পায় যেন প্রতিবেশী চার্লি ও তার সন্তানের সফলতার মধ্যে, সে চায় নিজের ভাই বেনের মতো ভাগ্যের পরিবর্তন। উইলি যখন নিজের ব্যর্থতা আর পরিবারের ভারবহনে চিরক্লান্ত, তখন তারই ছোট ভাই বেন মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে পরিবার আর আপনজনের মোহ ত্যাগ করে ভাগ্যের সন্ধানে পাড়ি জমায় আফ্রিকায়, পরবর্তীতে হয়ে ওঠে ব্যাপক বিত্ত-বৈভবের অধিকারী। জীবনের শেষ পর্যন্ত বড়ো ভাই উইলি আশা করে, কোনো একদিন বেন ফিরে এসে তার জীবনযুদ্ধের কষ্ট লাঘব করবে, তার সন্তানদের প্রতি স্নেহাশীর্বাদ রেখে তাদের দেবে সঠিক পথের সন্ধান। পরিবর্তিত হবে তার ভাগ্য, পরিবর্তিত হবে তার জীবন। আর সে পরিবর্তন আনার চেষ্টাতে একদিন জীবনেরই গল্পের পরিবর্তন করে ফেলে সে। আমেরিকান মধ্যবিত্ত জীবনের গল্প বলা এই নাটকটি এমন এক সময়কার, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ করে দেশটির অর্থনীতি নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে। আগের গ্রাম ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতি হয়ে উঠছে শহরমুখী ও শিল্প-কারখানা নির্ভর। তীব্র পুঁজিবাদ সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, ধনীরা যতো দ্রুত আরো ধনী হচ্ছে, তত দ্রুতই নেমে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জীবনমান। সে সময় মানুষের মূল্যবোধ পরিবর্তিত হয় দ্রুত, আগের ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের ওপর প্রকট হয়ে ওঠে নতুন চিন্তাধারা। মুক্ত স্বাধীন জীবনের চেয়ে মানুষের কাছে তখন প্রিয় হচ্ছে বিত্ত-বৈভবে পূর্ণ জীবন, একে অপরের কাছে নিজেকে শ্রেষ্ঠতর প্রমাণ করার এক দুর্দান্ত প্রতিযোগিতা তখন সর্বত্র। সমাজে তখন থেকেই সম্পদ আর প্রতিষ্ঠার ওপর ভিত্তি করে মানুষের মূল্যায়ন প্রকট আকার ধারণ করেছে। এমনই এক সময়ের প্রতিনিধিত্ব করা নাটক আমেরিকান লেখক মিলারের 'ডেথ অফ এ সেলসম্যান।' গল্প শুরু হয় উইলির কর্মজীবনের ব্যর্থতার কথা দিয়ে। স্ত্রীর সাথে রান্নাঘরের আলাপচারিতায় ফুটে ওঠে সেলসম্যান হিসেবে বৃদ্ধ উইলির ব্যর্থতার চিহ্ন, পাওয়া যায় স্বামী হিসাবে উইলির ব্যর্থতার পরিচয়। অন্য নারীর প্রতি পুরুষসুলভ আকর্ষণে যে উইলি বিশ্বাস ভাঙে স্ত্রী লিন্ডার, সে উইলিই সহানুভূতি আর বিশ্বাসের খোঁজে আমৃত্যু নির্ভর করে স্ত্রীর ওপর। দুই পুত্র বিফ আর হ্যাপি ভাগ্যের খোঁজে এদিক-ওদিক ঘোরে, কিন্তু উইলি ব্যর্থ হয় তাদের সঠিক পথ দেখাতে, ব্যর্থ হয় পুত্রের সামনে উত্তম পিতার উদাহরণ সৃষ্টি করতে। দুই ভাইকে পাওয়া যায় পিতার সঙ্গের চেয়ে ছলনাময়ী অর্থলোভী নারীর সঙ্গ বেশি উপভোগ করতে। এযেন আজকের পৃথিবীর হাজারো নিম্নবিত্ত যুদ্ধরত পিতার আয়না। উইলির চরিত্র যেন আরো লাখো পরনারীপ্রীত কিন্তু স্ত্রীর প্রতি একান্ত নির্ভরশীল স্বামীর প্রতিচ্ছবি।

পুঁজিবাদী পৃথিবীতে মধ্যবিত্তের মৃত্যু, আজকের বিশ্বের অর্থনীতিটাই যেন ভোগের, একে অপরকে ভোগ করবে বস্তুসামগ্রীর মতো, কোম্পানিগুলো নিজের শ্রমিকদের রক্ত-মাংস থেকে মন ও মনন পর্যন্ত চুষে খাবে, অতঃপর পরিত্যক্ত ছোবড়া ত্যাগ করে তাকাবে নতুন শ্রম বাজারের দিকে। এটাই যেন বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির পুঁজিতত্ত্বের লুকানো রহস্য। আর এই নিংড়ে নেওয়ার অর্থনীতির পরতে পরতে লুকোনো থাকে হাজারো লাখো সাধারণ মানুষ ও তাদের পরিবারের গল্প, লুকোনো থাকে তাদের নানা রঙের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্ন ভাঙার কাহিনী। এরকমই এক স্বপ্ন ভাঙার গল্প নিয়ে তৈরি আর্থার মিলারের 'ডেথ অব এ সেলসম্যান' নাটকটি।



মঞ্চে

উইলি লোমান- তৌহিদ বিপ্লব, উর্মিল মজুমদার

লিন্ডা - পলি চৌধুরী, তাসমিয়া মীম

বিফ লোমান- মোঃ মাইনুল ইসলাম (তাওহীদ)

বিফ লোমান (ছোট) - রাম কান্ত মন্ডল শ্রীকান্ত

হ্যাপি লোমান- আহমেদ সুজন

হ্যাপি লোমান (ছোট)- নাজমুল নাঈম

চার্লি- আমিরুল মামুন

বেন- আব্দুল হাই

স্ত্রীলোক- তাসমিয়া মীম, পলি চৌধুরী

হাওয়ার্ড- আব্দুর রহমান সোহাগ

বার্নাড- লিটু রায়

বার্নাড (ছোট)- পৃথু অভিষেক

স্টানলি - সায়েদুর রহমান (নয়ন)

ফোরসাঈদ- ফারাবী জামান শেহজাদী

লেটা - অর্নিলা অচিন

নেপথ্যে

রচনা - আর্থার মিলার

অনুবাদ- ফতেহ্ লোহানী

নির্দেশনা ও মঞ্চরূপ - আশিকুর রহমান লিয়ন

সহঃ নির্দেশনা ও আলোক পরিকল্পক - ধীমান চন্দ্র বর্মণ

পোষাক পরিকল্পক- কাজী তামান্না হক সিগমা

আবহ সঙ্গীত পরিকল্পক- নাভেদ রহমান

রুপসজ্জা- জনি সেন

আবহ সঙ্গীত প্রক্ষেপণ - নাভেদ রহমান, ফারজানা মহুয়া

আলোক প্রক্ষেপণ - ধীমান চন্দ্র বর্মণ, রুহুল আমিন রাজা

পোস্টার ডিজাইন- দেবাশীষ কুমার দে প্রশান্ত

প্রকাশনা - রিগ্যান সোহাগ রত্ন, জহির রায়হান

প্রচার - আবু হায়াত মাহমুদ, তৌহিদ বিপ্লব, আহমেদ সুজন ও জয়নাল আবেদিন মনির

হল ব্যবস্থাপনা- আবু হায়াত মাহমুদ, জাহিদুল ইসলাম, রিগ্যান সোহাগ রত্ন, বন্ধু তুহিন, ইউসুফ পলাশ, সায়েম সিদ্দিক অপু, জয়নাল আবেদিন মনির, ডালিম মিলাদ, মাহমুদুল হাসান, এম এম আর মিঠুন ও মিজানুর রহমান।

প্রযোজনা ব্যবস্থাপনা- মোঃ মাইনুল ইসলাম (তাওহীদ), আবু হায়াত মাহমুদ, আমিরুল মামুন, জাহিদুল ইসলাম, মীর সালাউদ্দিন বাবু, রুহুল আমিন রাজা, তৌহিদ বিপ্লব, আব্দুল হাই, সায়েদুর রহমান, আহমেদ সুজন, লিটু রায় ও উর্মিল মজুমদার।



নির্দেশকের কথা

'ডেথ অফ এ সেলসম্যান' প্রযোজনাটি দর্শকের সামনে শুধুমাত্র একটি নাট্যশিল্পকর্ম হিসেবে কখনই আমরা উপস্হাপন করতে চাইনা। বরং চেয়েছি পুঁজিবাদী সমাজে যেখানে আমাদের আবাস, সেখানে প্রতিমুহূর্তে যে নিরন্তর লড়াই করে আমরা বেঁচে থাকার চেষ্টা করি বা মারা যাই- সেই ট্র্যাজিক বাস্তবতার নির্যাস কিছুটা হলেও যাতে ধরা দেয়। পুঁজিবাদের বেড়াজালে যে সমাজের জন্ম, সেই সমাজে জনগনের অস্তিত্বের মাপকাঠি নিরূপিত হয় টাকার পাল্লায়। আর এমন আত্মকেন্দ্রীক সমাজে বিত্তের কাছে যখন ব্যক্তির সত্তা পরাজিত হয় তখনই নেমে আসে চরম ট্র্যাজেডি।

আর্থার মিলার এই নাটকে সামন্ততান্ত্রিক চির অভ্যস্ত চেতনার ধারক ব্যাক্তির জীবন সংগ্রাম, স্মৃতি, অনুশোচনা, বাবা-ছেলের বাৎসল্য ও টানাপোড়ন, নারী-পুরুষের সম্পর্কের দমনমূলক চিত্রের জটিলতা ইত্যাদি চিত্রণে পুঁজিবাদী সমজকে উপস্হাপন করেছেন ক্ষুধার্ত রাক্ষসরূপে। ফলে বাংলাদেশের মেট্রোপলিটন সমকালীন জীবন বাস্তবতায় এই নাট্যপ্রযোজনা হয়ে ওঠে আমাদের সমাজের, আমাদের সময়ের আয়না।

Stream of Consciousness ধারায় রচিত নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্রের অস্থিরতা, স্ববিরোধিতা, আশাবাদ আর নৈরাশ্যের অস্হির দোলাচল, অতীতের ফ্ল্যাসব্যাক, সংসার-সম্পর্ক-প্রেম ইত্যাদি প্রকাশে বাস্তববাদী অভিনয় পদ্ধতির মনস্তাত্ত্বিক নির্যাসের সাথে যুতসই অনুসঙ্গী হয়েছে অভিব্যক্তিবাদী প্রকাশ। আর মঞ্চরূপে প্রয়োগ হয়েছে সাজেস্টিভ রিয়েলিজম।

একজন সেলসম্যানের মৃত্যুর অর্থ কি, একজন মানুষের মৃত্যু নয়? অর্থাৎ এই প্রযোজনার প্রতিটি পরতে পরতে পুঁজিবাদী সমাজে আমরা কিভাবে বেঁচে আছি আর কিভাবে মারা যাই প্রতিমুহূর্তে, সে বিষয়েই প্রশ্ন করে চলে।

আমি কৃতজ্ঞ বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গণে নব্যতরঙ্গরূপে আবির্ভূত নতুন দল থিয়েটারিয়ানের প্রতি, আমাকে তাঁদের প্রথম প্রযোজনার নির্দেশক হিসেবে নির্বাচন করার জন্য। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি প্রযোজনার সহকারী নির্দেশক ও আলোক পরিকল্পক, রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক বিভাগের শিক্ষক ধীমানচন্দ্র বর্মণের প্রতি। কারণ শিল্পসৃজনে নিঃসঙ্গতার অনুভূতিকে তিনি আমার আশেপাশে ভিড়তে দেননি কখনই। ধন্যবাদ নাটকের পোশাক পরিকল্পক কাজী তামান্না হক সিগমা এবং আবহ সঙ্গীত পরিকল্পক নাভেদ রহমানসহ সকল কলাকুশলীবৃন্দ। হৃদয়ের অন্তঃস্হল থেকে ভালোবাসা জানাই আমার সাহসী অভিনেতাদের প্রতি, যারা বিগত তিনমাস নানা সময়ে আমার অনুপস্হিতি থাকা সত্যেয় নিরলস কাজ করে গেসেন অবিরাম।

ধন্যবাদান্তে

আশিকুর রহমান লিয়ন

নির্দেশক ও মঞ্চরূপ

চেয়ারম্যান, থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


থিয়েটারিয়ান

থিয়েটারিয়ান প্রথমত মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে।ব্যক্তি, দল, রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রে এই মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতিফলন ঘটানোর দায়বদ্ধতা নিয়ে ২০২০ সালের মহান বিজয় দিবসে থিয়েটারিয়ান-এর পথচলা শুরু। নাট্য-প্রয়োগে নতুনত্ব , বিষয়বস্তুতে বৈচিত্র্য এবং আধুনিক বাংলা থিয়েটারের বিকাশে থিয়েটারিয়ানের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। যার মূল লক্ষ্য হবে বৈষম্যহীন, মানবিক সমাজ গঠন। থিয়েটারিয়ান সত্য এবং সুন্দরের পক্ষে দাঁড়িয়ে মেধা, মনন ও সৃজনের মাধ্যমে থিয়েটারকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট থাকবে। সকল দলের নাট্যকর্মীদের পারস্পরিক মেলবন্ধন সৃষ্টিই হবে থিয়েটারিয়ানের অন্তরের অভিপ্রায়। থিয়েটারিয়ান শিল্পের সকল ক্ষেত্রে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাবে । তবে সবার আগে প্রাধান্য দেবে নাটক মঞ্চায়ন। দেশ-বিদেশের মান-সম্পন্ন নাটক মঞ্চে আনবে থিয়েটারিয়ান। একটি প্রগতিকামী উদারনৈতিক দেশ গঠনের বার্তা দিতে থিয়েটারই হবে থিয়েটারিয়ানের প্রধান বাহন।


https://www.facebook.com/theaterianbd/

https://www.facebook.com/theaterianbangladesh