আজফার হোসেনের ‘দর্শনাখ্যান’

আজফার হোসেনের ‘দর্শনাখ্যান’


আজফার হোসেন: তাত্ত্বিক, সমালোচক ও অ্যাক্টিভিস্ট। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আন্তঃশাস্ত্রীয় বিদ্যার অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করার পর ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি ও বিশ্বসাহিত্যে ডক্টরেট করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে ইউনিভার্সিটি অফ লিবারাল আর্টস, নর্থ সাউথ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াশিংটন স্টেট, বৌলিং গ্রিন স্টেট ও ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্য, কালচারাল স্টাডিজ এবং এথনিক স্টাডিজ পড়িয়েছেন। ভাষা, সাহিত্য, সাহিত্যতত্ত্ব, সংস্কৃতি, দর্শন, ইতিহাস, রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং রাজনীতি-সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তাঁর কয়েক শ' প্রবন্ধ ও নিবন্ধ দেশে ও বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি ভাষা থেকে তাঁর ইংরেজি অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ-এর সহ-সভাপতি তিনি। পাশাপাশি বিপ্লবী গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে The Wor(l)d in Question: Essays in Political Economy and Cultural Politics (২০০৮), দর্শনাখ্যান (২০১৯), পাঠ: শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের রাজনীতি (২০২২), চিহ্ন ভাসে অবশেষে (২০২৩)।




আজফার হোসেনের ‘দর্শনাখ্যান’


 ১. যাকে সমাজ ‘মান ভাষা’ হিসেবে ধরে নেয় বা ঠিক করে দেয়, সেখানে সকলের প্রবেশাধিকার সমান নয়।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


২. পুঁজিবাদী ব্যাবস্থায় ভাষার বিনিময়-মূল্য বলতে বোঝায় বাজারে ভাষার কেনা-বেচাকে।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


৩. ভাষা যখন পণ্য হয়ে ওঠে এবং এ কারণেই যখন ভাষাকে বেচা যায় (বা কেনা যায়), তখন ওই ভাষার বিনিময়-মূল্য থাকে।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


৪. পুঁজিবাদী বিশ্বে আজ বিজ্ঞাপনের বিস্ফোরণ যে ভাষিক সাম্রাজ্য তৈরি করেছে, তার কবলে পড়ে চৈতন্য নিজেই ভোঁতা হতে থাকে এমন মাত্রায় যে, একটি বিষয়ের সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ক, কিংবা সাধারণের সঙ্গে নির্দিষ্টের সম্পর্ক, ধরতে গিয়ে অনেকেরই চিন্তা হাঁসফাঁস করতে থাকে কিংবা পুরোপুরি ব্যার্থও হয়।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


৫. আমরা পুঁজির যুগে বাস করি বলেই একই সঙ্গে ভাষার, চিন্তার ও সম্পর্কের ‘শর্ট সার্কিটিং’-এর যুগেও বাস করি। সে কারণেই তো ধরতে পারি না মোবাইল ফোনে কথা বলার সঙ্গে বাংলাদেশের কৃষকের রক্ত-ঝরার সম্পর্ক কি।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


৬. ভাষা আমাদেরকে যেমন ব্যবহার করে, তেমনি আমরা ভাষাকেও ব্যবহার করি। এই ‘ডায়ালেকটিক্’ এও বলে দেয় যে, মানুষ ও ভাষা কোনোটাই চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে সার্বভৌম নয়।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


৭. ভাষা কোন কিছুকে যেমন প্রকাশ করতে পারে, তেমনি তাকে প্রচ্ছন্নও করে।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


৮. ভাষা নিয়ে শেষ কথা থাকে না বলেই ভাষা নিয়ে কথা থাকে।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


৯. ভাষা হতে পারে রক্তাক্ত লড়াইয়ের ময়দান, যেমন ভাষা হতে পারে ব্যকরণের বিরুদ্ধেও লড়াইয়ের ক্ষেত্র। আবার ভাষা হতে পারে শ্রেণি-সংগ্রাম, বর্ণ-সংগ্রাম, জেন্ডার-সংগ্রাম এবং জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের এলাকা। লড়াই নিজেই হয়ে উঠতে পারে বাস্তব জীবনের ভাষা।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


১০. তোমাদের বন্দুক, বুলেট আর বেয়োনেট নৈঃশব্দ্যকে ছিঁড়ে ফেলেছে। খান খান হয়ে-যাওয়া নৈঃশব্দ্যের ভেতর থেকে আরো নৈঃশব্দ্য জেগে ওঠে।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


১১. আমি অপেক্ষায় আছি সেই মুহূর্তের, যখন নৈঃশব্দ্য ফেটে পড়বে, বলকাবে মুক্তির ইশতেহারের মতো, ফুটবে কবিতার অক্ষরের মতো, আর গর্জে উঠবে কণ্ঠস্বর হয়ে ইতিহাসের ময়দানে বা মঞ্চে।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


১২. পৃথিবীর আদি চিৎকারের নাম নৈঃশব্দ্য।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান



১৩. নৈঃশব্দ্য ছোঁয়া যায়। শিশিরে হাত রাখার মুহূর্তে নৈঃশব্দ্য ছুঁয়ে নেয়া যায়। আমাকে ফিরিয়ে দেয়ার মুহূর্তে তোমার হাত স্পর্শ করতেই আমি ছুঁয়েছিলাম এক গভীর নৈঃশব্দ্যকে।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


১৪. বিরহব্যথা গভীর হতে হতে ব্যথা রূপান্তরিত হয় নৈঃশব্দ্যে।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


১৫. নৈঃশব্দ্য দিয়েই সে আমাকে বুঝিয়ে দেয় তার ভালোবাসা। নৈঃশব্দ্য দিয়েই সে আমায় বলে, ‘আমি তোমাকে ঘৃণা করি’।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


১৬. নৈঃশব্দ্য পাতলা কাঁচ নয়। ইচ্ছে করলেই তাকে ভেঙে ফেলা যায় না।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


১৭. মাত্র দুই মিনিটের নৈঃশব্দ্য দিয়ে তুমি আমার ভালোবাসাকে খতম করেছো।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


১৮. ফ্যাসিস্টরা শব্দকে তো বটেই, এমনকি নৈঃশব্দ্যকেও নিষিদ্ধ করতে চায়।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


১৯. পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এমনভাবে চালু থাকে—ভূমি থেকে মগজ পর্যন্ত—যে, আমরা খালি চোখে ওই ঘামের চিহ্ন বা রক্তের দাগ দেখতে পাই না।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


২০. পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় আমাদের শার্টে লেগে থাকে রক্তের দাগ, আমাদের চশমায় লেগে থাকে ঘামের চিহ্ন। কিন্তু নৈঃশব্দ্যের নিচে চাপা পড়ে থাকে ওই ঘাম ও রক্ত—খেটে খাওয়া মানুষের ঘাম ও রক্ত।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


২১. পুঁজি যা লুকায়, মার্কস তা দেখান।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


২২. জড়ো হতে হতে হতে হতে নৈঃশব্দ্যরা গর্জে ওঠে ইতিহাসের ভেতরেই।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


২৩. মানুষ স্থানের নাম দেয়, স্থানও মানুষের নাম দেয়।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


২৪. স্থান হারিয়ে ফেলার অর্থ হচ্ছে পরিচয় হারিয়ে ফেলা। পরিচয় হারিয়ে ফেলার অর্থ আবার স্থান হারিয়ে ফেলা।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


২৫. নতুন মানচিত্র পেয়েছি, কিন্তু সর্বসাধারণের মুক্তি কি এসেছে?

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


২৬. হেজিমনি হচ্ছে সেই ধরনের মতাদর্শিক আধিপত্য যা সর্বসাধারণের সম্মতিক্রমেই প্রতিষ্ঠিত ও বিস্তৃত হয়। অর্থাৎ হেজিমনি মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে না; বরঞ্চ মাথায় হাত বুলিয়ে মাথার ভিতরেই ঢুকিয়ে দেয় এমন সব ধ্যান ধারণা, যাদেরকে সত্য, স্বাভাবিক, সুন্দর, সভ্য মনে হয়। মনে হয় ধারণাগুলো মঙ্গলময়। সেচ্ছায় আমরা ওইসব ধারণাকে গ্রহণ করি বা মেনে নিই। যেমন ঔপনিবেশিক হেজিমনি এই ধারণাটাকে দারুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, ইংরেজি ভাষা জানা মানে শিক্ষিত হওয়া। আরো ধারণা জারি আছে, যেমনঃ ফর্সা হওয়া মানেই সুন্দর হওয়া। এই ধারণাটাকে অবশ্য গ্রহণ করানোর জন্য সাদা চামড়ার মানুষেরা বন্দুক হাতে আমাদের বাড়ির দোরগোড়ায় বসে নেই। বরঞ্চ আমরা অনেকেই এই ধারণাটাকে গ্রহণ করে বসে আছি।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


২৭. চিহ্ন মোছারও চিহ্ন থাকে।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান


২৮. কসম খোদার, আমি গন্ধ নিয়ে লাইনের পর লাইন লিখে যেতে পারি। কিন্তু চাই সেই গন্ধ, সেই সৃষ্টির গন্ধ, সেই ধ্বংসের গন্ধ, সেই জগতজোড়া প্রেমিক-বিদ্রোহী গন্ধ যা শুঁকে শুঁকে আমাদের প্রেম মহিমান্বিত হবে আর একেকটা স্বৈরাচার এবং একেকটা পুঁজিপতি ধপাস করে মুখ থুবড়ে পড়বে নির্যাতিতের পায়ের নিচে।

— আজফার হোসেন, দর্শনাখ্যান