ভাষা নিয়ে আজফার হোসেনের কিছু ভাবনা

 ভাষা নিয়ে আজফার হোসেনের কিছু ভাবনা 

ভাষা নিয়ে কথা থাকে: আজফার হোসেন

শুরু থেকেই চেতনা ‘বস্তুর ভারে ভারাক্রান্ত’ থাকার অভিশাপে পীড়িত। ভাষা হচ্ছে চৈতন্যের সমবয়সী। ভাষা হচ্ছে ব্যবহারিক চৈতন্য, যা অন্য মানুষের জন্য হাজির থাকে বলেই আমার জন্যও ব্যক্তিগতভাবে তা হাজির থাকে।

— কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস্, (দ্য জার্মান আইডিয়লজি)

প্রতিটি ভাষাই একটি বিশ্ববীক্ষার ও সংস্কৃতির উপাদান ধারণ করে থাকে।

— আন্তোনিও গ্রামসি, (প্রিজন নোটবুকস)

১.

বারবার ইতিহাসের ভেতর থেকেই দারুণ পিপাসার ছটফটানি নিয়েই ওই প্রশ্নগুলো জাগতে থাকে: ভাষা কি? কী তার ঠিকানা, কী তার সীমানা, নিশানা? ইতিহাসই বলে, ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে পুরনো প্রশ্নগুলো নতুন করে জাগে এবং উত্তরের অপেক্ষায় প্রশ্নগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে দুনিয়ার সমস্ত অতৃপ্তি জড়ো করে। প্রশ্নের চাপ নিজেই আবার আমাদেরকে কোনো না কোনো পথ ধরিয়ে দেয়। আমরা হয়ত একটা পথেই আছি।

২.

একটা পথ ধরে এগুলে কিছু কথা বলে নেয়া যাবে, যদিও ভাষা প্রশ্নে আমাদের পথ একটা নয়। তাহলে শুরুর কথাটা এমনভাবে পাড়া যায় : আমরা যদি ‘ভাষা কি?’ এই প্রশ্নের পথ ধরে ভাষা কীভাবে দুনিয়ায় কাজ করে তা বিবেচনায় রাখি, তাহলে ভাষাকে আমরা নির্দিষ্ট সামাজিক উৎপাদন-সম্পর্কের ভেতরে এনে দেখতে পারি। হ্যাঁ, ভাষা নিজেই সামাজিক উৎপাদন-সম্পর্কের ভেতরে অবস্থান করে।

৩.

ভাষার দেহে উৎপাদন-সম্পর্কের ময়লা জড়ো হতে থাকে। বলা যাবে, ভাষা আগেভাগেই ময়লা হয়ে আছে। আর উৎপাদন-সম্পর্ক মানেই কেবল অর্থনৈতিক সম্পর্ক নয়। বা উৎপাদন বলতে কেবল পণ্যোৎপাদন বোঝাবো না, যদিও তা জরুরি। যেহেতু মানুষের কাজ একটি নয়, তার উৎপাদন-সম্পর্কও একটি নয়। ‘দিগন্ত’-এর রূপক ব্যবহার করে আমরা বলতে পারি যে, উৎপাদন-সম্পর্কের দিগন্ত মানুষের অনুশীলনের সমগ্রকে ধারণ করে। তাহলে মানুষ কী কী কাজ করে তার সঙ্গে সে কী ধরনের ভাষা ব্যবহার করে তার যোগাযোগ রয়েছে, যদিও সে যোগাযোগ মোটেই যান্ত্রিক নয়। এও বলা যাবে, কাজ ও চৈতন্যের বা জীবন ও চেতনার কিংবা বস্তু ও ভাবের মধ্যস্থতা করে ভাষা। ভাষার ৯৯টা নাম দেয়া সম্ভব। তবে এখানে ভাষার একটা গুরুত্বপূর্ণ নাম বলে দেয়া যাক : ‘মধ্যস্থতাকারী’। বিষয়গুলো পরে খোলসা করা যাবে।

৪.

আগেই ইঙ্গিতটা ছড়ানো হয়েছে যে, ভাষা কোনো বিশুদ্ধ শূন্যে অবস্থান করে না। এও বলে নেয়া হল যে, ভাষা মধ্যস্থতাকারী। কিন্তু ভাষার মধ্যস্থতার রকমফের রয়েছে। তার একটি গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতার ধরন ত্রিমাত্রিক: সে মধ্যস্থতা করে নিজের সঙ্গে চৈতন্যের, চৈতন্যের সঙ্গে বস্তুজগতের, এবং বস্তুজগতের সঙ্গে নিজের। এই বস্তুজগতে মানুষ নিজেকেই পুনরুৎপাদিত করে থাকে তার প্রাত্যহিক বস্তুক জীবনের পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে। এই যে আমরা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠি, বাহ্য করি, খাই-দাই, কাজ করি, বা গান শুনি, ঘুমাই।। এগুলো ওই পুনরুৎপাদনের প্রাত্যহিক ছন্দঃস্পন্দ তৈরি করে, তা যতই একঘেঁয়ে হোক না কেন! ভাষাও ওই পুনরুৎপাদনের প্রাত্যহিক ছন্দঃস্পন্দে ভারাক্রান্ত থাকে। অন্য কথায়, ভাষা বস্তুর বা বস্তুজগতের ভারে ভারাক্রান্ত থাকে। এই ধারণাটি এসেছে মার্কস ও এঙ্গেলস-এর কাজ ‘দ্য জার্মান আইডিয়লজি’ থেকে। আবার তাদের ইঙ্গিত মোতাবেকই, বস্তুজগতও ভাষার ভারে ভারাক্রান্ত থাকে। অর্থাৎ, সহজ কথায়, যে পৃথিবীকে আমরা চিনি বলে মনে করি, সে পৃথিবীটাকে আমরা চিনি, বা সেই পৃথিবীটা আছে কি নেই তা জানি, ভাষার ভেতর দিয়েই।

৫.

ওপরের চারটি প্রস্তাব ও বয়ানের লজিক ও ইঙ্গিত অনুসারে বলা যাবে যে, পৃথিবীতে যেমন বিশুদ্ধ চৈতন্য বলে কিছু নেই, ঠিক তেমনি পৃথিবীতে বিশুদ্ধ ভাষা বলে কিছু নেই। ভাষা আগেভাগেই নোংরা হয়ে আছে। এমনকি আধুনিক জ্যামিতির টপোলজির ভাষা বা ফরাসি কবি স্তেফান মালার্মের অভীষ্ট সাঙ্গীতিকতা, যা ব্যকরণিক ভাষাকে নাকোচ করে দেয়, কোনোটাই বস্তুজগতের ময়লা এড়াতে পারে না, যেমন গণিত ও সঙ্গীতের বিমূর্ত কম্পোজিশানও ওই ময়লা এড়াতে পারে না। একটি গাণিতিক নির্মাণে ‘ক’ প্রতীকের সঙ্গে ‘(ক-খ)’ বা ‘(ক+খ)’-এর সম্পর্ক বস্তুজগতে সংঘটিত অনেক ঘটনাকে ভাবের সঙ্গে ভাষার মধ্যস্থতার ভেতর দিয়ে বিভিন্ন কায়দায় নির্দেশ করতে পারে। যেমন সঙ্গীতও বিভিন্ন ভাবেই প্রকৃতি ও দেহের ভাষিক অভিজ্ঞতাকে নির্দেশ করতে পারে।

৬.

ভাষা নিজেই বস্তুক। কথাটা বলার অর্থ এই নয় যে, বস্তু আগে, ভাষা পরে; বা ভাষা আগে, বস্তু পরে। তাহলে কী অর্থে ভাষা বস্তুক? আবারও ফিরে আসে মধ্যস্থতার প্রশ্ন, বস্তুজগতের প্রসঙ্গ। অর্থাৎ বস্তুজগতের সঙ্গে ভাষা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সম্পর্কিত থাকার কারণে ভাষাকে বস্তুক বলা যায়। কিন্তু ভাষা আরেকটি অর্থে এবং তাৎক্ষণিক অর্থেও বস্তুক বটে : ভাষা উৎপাদিত, উৎসারিত ও বিকীরিত হয় দেহ থেকে। আর তাৎক্ষণিক অর্থে দেহ হচ্ছে একটি কংক্রিট, বস্তুক এলাকা (যদিও অনেকের কাছে দেহ হয়ে ওঠে দারুণ রহস্যময় দুনিয়া)। ভাষা কেবল বলার মাধ্যম নয়। ভাষা কেবল লেখার মাধ্যম নয়। ভাষা কেবল ইশারার বিষয়ও নয়। কিন্তু যে ভাষা আমরা বলি বা এমনকি লেখি, তা দেহজ। ইঙ্গিতটা এসেছে মার্কস ও এঙ্গেলসের ‘দ্য জার্মান আইডিয়োলজি’ থেকেই। বলা যাবে, মার্কস ও এঙ্গেলস এক অর্থে ভাষার এক ধরনের দেহতত্ত্বের সম্ভাবনাকে হাজির করেছেন। ভাষার দেহতত্ত্বকে সম্প্রসারিত করে বলতে পারি যে, আমরা দেহ দিয়ে ভাষা বলি, দেহ দিয়ে ভাষা লিখি, দেহ দিয়েই ‘নতুন’ ভাষা নির্মাণ করি, দেহ দিয়ে ভাষায় প্রবেশ করি, দেহ দিয়ে চৈতন্যের সঙ্গে বা এমনকি ভাষার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করি। এ প্রসঙ্গে আমরা কমিউনিটির বা সমষ্টির বা সমাজের দেহের কথাও বলতে পারি। ভাষার দেহতত্ত্ব প্রসঙ্গে লালন ফকিরের কথা চলে আসে। তার অনেক গান থেকে একাধিক ইঙ্গিত জড়ো করে বলা যাবে যে, দেহ হচ্ছে ভাষার আবাসভূমি বা ভাষার চাষবাসের ক্ষেত্র। এক অর্থে যেখানে দেহ নেই, সেখানে ভাষাও নেই।

৭.

দুনিয়ায় যেভাবে ভাষা কাজ করে তাকে দেখার অসংখ্য পদ্ধতি আছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হচ্ছে রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্যাটাগরির নিরিখে ভাষাকে একটি সামাজিক উৎপাদন-প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা। তবে ‘উৎপাদন’ ক্যাটাগরিটা কেবল উৎপাদনে সীমাবদ্ধ নয়। ‘উৎপাদন’ নিজেই সম্পর্কের একটি আপেক্ষিক সমগ্রকে টেনে আনে। এই সমগ্রে থাকে আরো তিনটি ক্যাটাগরি : বিনিময়, বন্টন ও ভোগ। উৎপাদন, বিনিময়, বন্টন ও ভোগ পরস্পর-সম্পর্কিত। আর পরস্পর-সম্পর্কিত হয়ে এরা একটা বিশেষ সমগ্র তৈরি করে। কথাগুলো বলে নিলাম মার্কসের অসম্পূর্ণ কিন্তু মহাকাব্যিক আয়তনের মহড়ামূলক তাত্ত্বিক কাজ—রাজনৈতিক অর্থনীতির কাজ—‘গ্রুনড্রিস’-এর বরাতে। হ্যাঁ, আমরা যখন কোনো কিছুর বন্টনের কথা বলি, তখন তার উৎপাদনের কথাও ধরে নিয়ে থাকি। আর উৎপাদন না হলে বিনিময় বা ভোগের প্রশ্নও আসে না। অর্থাৎ এগুলো পরস্পর-সম্পর্কিত। এবারে ফিরি ভাষা প্রসঙ্গে। হ্যাঁ, একটি সমাজে ভাষার উৎপাদন-বিনিময়-বন্টন-ভোগের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। একটি সমাজে প্রতিটি মুহূর্তেই ভাষা উৎপাদিত হয়ে বিনিময়-প্রক্রিয়ার ভেতরে প্রবেশ করে এবং ভোক্তাও তৈরি করে। আর ভাষার বন্টন? ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ, সংস্কৃতিসহ এমনকি ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও অভিজ্ঞতাও ভাষিক রসদকে অবশ্যই অসমভাবে সমাজের বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে বন্টন করে থাকে। ধরা যাক ‘মান ভাষা’র কথা। যাকে সমাজ ‘মান ভাষা’ হিসেবে ধরে নেয় বা ঠিক করে দেয়, সেখানে সকলের প্রবেশাধিকার সমান নয়। যেমন বাংলাদেশে সকলেই ‘প্রমিত বাংলা’ ব্যবহার করার ক্ষমতা রাখেন না, কেননা এই সমাজেই বিরাজ করে অসম উৎপাদন-সম্পর্ক এবং অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক। তাহলে এভাবেও বলা যায় : এই সমাজে বিরাজ করে অসম ‘ভাষিক-উৎপাদন/ক্ষমতা-সম্পর্ক’, যার নিরিখেই আমরা বাংলাদেশে ইংরেজির সঙ্গে বাংলার অসম সম্পর্ক এবং বাংলার সঙ্গে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ভাষার অসম সম্পর্ককে দেখে নিতে পারি।

৮.

রাজনৈতিক অর্থনীতির এলাকায় উৎপাদন-সম্পর্কের ধারণাটা মূল্যের ধারণার সঙ্গে যুক্ত থাকে। ভাষার ক্ষেত্রে মূল্যের ধারণাটাকেও প্রয়োগ করা যায়। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি ‘ভাষিক মূল্য’-এর কথা; বলতে পারি ওই ভাষিক মূল্যের উৎপাদন-বিনিময়-বন্টন-ভোগের কথা। ভাষিক মূল্য নিয়ে কথা বলতে গেলে আমরা আবার ভাষার ব্যবহারিক মূল্য ও বিনিময়-মূল্যের কথাও বলতে পারি। ভাষার ব্যবহারিক মূল্যটা ওই জায়গায় যেখানে ভাষা আমাদের নির্দিষ্ট অভাব পূরণ করে; বা ভাষা আমাদের নির্দিষ্ট কাজে লাগে। আর ভাষার বিনিময়-মূল্যের দু’টো রূপ ধরা যেতে পারে। একটি হচ্ছে সত্তাগত বিনিময়-মূল্য আর অপরটি ‘রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিনিময়-মূল্য।’ সত্তাগত বিনিময়-মূল্য সরাসরিই বুঝিয়ে দেয় যে, ভাষাকে ভাষা হয়ে উঠতে গেলে একটি সামাজিক স্পেসে একাধিক কর্তাসত্তার মধ্যে তাকে বিনিময়যোগ্য হতে হয়। আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ভাষার বিনিময়-মূল্য বলতে বোঝায় বাজারে ভাষার কেনা-বেচাকে। অর্থাৎ ভাষা যখন পণ্য হয়ে ওঠে এবং এ কারণেই যখন ভাষাকে বেচা যায় (বা কেনা যায়), তখন ওই ভাষার বিনিময়-মূল্য থাকে। অর্থাৎ আমি যখন আমার মায়ের বা বন্ধুর সাথে কথা বলি, তখন ভাষার থাকে ব্যবহারিক মূল্য ও সত্তাগত বিনিময়-মূল্য। আর একজন আইনজীবী যখন ফিসের বিনিময়ে আমার সঙ্গে কথা বলেন, তখন ওই আইনজীবীর ভাষা পুঁজিবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতির নিরিখে একই সঙ্গে ব্যবহারিক মূল্য ও বিনিময়-মূল্য অর্জন করে।

৯.

ভাষিক মূল্য কেবল ব্যবহারিক মূল্য আর বিনিময়-মূল্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ভাষিক মূল্যের বলয়ে আরো কিছু মূল্যের হদিস পাওয়া সম্ভব : আলংকারিক মূল্য, রাজনৈতিক মূল্য, মতাদর্শিক মূল্য, নৈতিক মূল্য, নান্দনিক মূল্য ইত্যাদি। কোন্ মূল্য কীভাবে উৎপাদন-বিনিময়-ভোগ-বন্টনের সমগ্রে কাজ করে তা অনেকাংশে নির্ভর করে কোনো বিশেষ সামাজিক-মতাদর্শিক স্পেসের ওপর। এভাবে, ধরা যাক, মুনাফার স্বার্থেই একটি ভাষার ব্যবহারিক মূল্য রূপান্তরিত হতে পারে বিনিময়-মূল্যে। আমরা দেখেছি কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্টার বাকস্’ নামের কফি-বিক্রেতা কোম্পানি তার কাগজের পেয়ালায় কিউবার বিপ্লবী উপনিবেশবাদবিরোধী কবি হোসে মার্তির কবিতার পংক্তি উদ্ধৃত করে তা বিক্রি করে। একইভাবে আগেই ময়লা-হয়ে-থাকা মার্তির হরফে পুঁজি তার নিজস্ব ময়লা জমায়। এই হরফ পুঁজির খপ্পরে পড়ে লাভ করে বাজার-মূল্য। অন্যদিকে আবার একটি ভাষার পুঁজিবিরোধী ‘রাজনৈতিক মূল্য’ও তৈরি হতে পারে। লড়াকু জনগণের কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত ভাষা, যাকে পুঁজি কোনোভাবেই বাগে আনতে পারে না, একটি বিশেষ রাজনৈতিক মূল্যকেই নির্দেশ করে বটে।

১০.

ভাষিক মূল্য আকাশ থেকে লাফিয়ে পড়ে না, কিংবা ভূমি ফুঁড়ে হঠাৎ তার উপস্থিতি ঘোষণা করে না। আগেই বলা হয়েছে, সামাজিক স্পেসে ভাষা উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত হয় বলেই ভাষিক মূল্য তৈরি করায় শ্রমের ভূমিকা থাকে। তাহলে এখানে ভাষিক মূল্যের এক ধরনের শ্রমতত্ত্বের কথা ভাবা যেতে পারে। বলা যেতে পারে, একটি নির্দিষ্ট শ্রম-প্রক্রিয়া চালু করা ছাড়া ভাষার উৎপাদন ও বিনিময় সম্ভব হয় না। ভাষা অবশ্য নিজেই শ্রম নয়। তবে ভাষাকে ‘কাজ’ হিসেবে বিবেচনা করলে সেখানে শ্রমের প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। সে ধরনের বিবেচনা এক ধরনের তাত্ত্বিক রূপ পরিগ্রহ করেছে কিছু ভাষার রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদের গবেষণায়।।এই কাজকে শ্রম-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে হয়।

১১.

ভাষার রাজনৈতিক অর্থনীতির একটি ঐতিহাসিক বস্তুবাদী চেহারাও দেখে নেয়া যায়, যদি ‘ভাষিক উৎপাদন-পদ্ধতি’র ধারণাটাকে আমরা সামনে আনি। হ্যাঁ, যদি ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে ঐতিহাসিকভাবেই উৎপাদিত কোনো ভাষিক উৎপাদন-পদ্ধতিকে সনাক্ত করা যায় এবং তাকে সাধারণীকৃত করা সম্ভব হয়, তাহলে ওই উৎপাদন-পদ্ধতির অন্তর্গত অংশ হিসেবে আমরা বলতে পারি ভাষিক উৎপাদন-সম্পর্কের এবং ভাষিক উৎপাদনের উপকরণের কথা। হ্যাঁ, আমি এখানে রাজনৈতিক অর্থনীতির পরিচিত কিছু ক্যাটাগরিকে স্থানান্তরিত করছি। তাহলে ভাষিক উৎপাদন-সম্পর্কের উদাহরণ হিসেবে বলতে হয় সমাজে ভাষা-ব্যবহারকারীর পারস্পরিক সম্পর্কের কথা, তাদের সামাজিক চুক্তির কথা, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভাষা-ব্যবহারকারীর সম্পর্কের কথা। অন্যদিকে ভাষিক উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক মুহূর্তে উপস্থিত থাকা সমস্ত ভাষিক রসদকে। এই রসদের মধ্যে পড়ে ধ্বনি, অক্ষর, শব্দ, বাক্য, দেহভঙ্গিসহ সমস্ত ভাষিক প্রযুক্তি, যার খতিয়ান বেশ দীর্ঘ হতে পারে। এখানে এও বলে নেয়া দরকার যে, সমাজে অসম উৎপাদন-সম্পর্ক ও ক্ষমতা-সম্পর্ক বিভিন্নভাবে মানুষের অনুশীলনকে স্পর্শ করতে থাকে বলেই একটি নির্দিষ্ট ভাষিক উৎপাদন-পদ্ধতিতে ভাষিক উৎপাদনের উপকরণে সমাজের সকল সদস্যের প্রবেশাধিকার সমান থাকে না। এ কারণেই তো আমরা বলে থাকি, সকলের ভাষার ‘জোর’ এক নয়।

১২.

ভাষিক উৎপাদন-পদ্ধতি একই সঙ্গে মতাদর্শিক উৎপাদন-পদ্ধতিও বটে। রুশ ভাষা-দার্শনিক ভি. এন. ভলোসিনভ্ তাঁর ‘মার্কসিজম এ্যান্ড দ্য ফিলসফি অব ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে ভাষা নিয়ে আলোচনার একেবারে গোড়াতেই মতাদর্শের ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁর একটা তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য এই: যে সব চিহ্নের সমগ্রকে ভাষা বলা যাবে, সেই সব চিহ্নের উপস্থিতি ছাড়া মতাদর্শের উৎপাদন সম্ভব নয়। মার্কসের পথ ধরে ভলোসিনভ ভাষার সঙ্গে চৈতন্যের বিরাজমান ও চলমান দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক খতিয়ে দেখতে আগ্রহী হয়েছেন এবং এই পর্যবেক্ষণটাকে বিশেষভাবে সামনে এনেছেন যে, ‘ব্যক্তিক চৈতন্য নিজেই সামাজিক-মতাদর্শিক ঘটনা।’ আর ভাষা হচ্ছে ব্যবহারিক চৈতন্য। তাহলে বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে এমন যে, ভাষা নিজেই ‘মতাদর্শিকতা’য় জারিত। আসলে মতাদর্শিকভাবে নিরীহ বা নিরপেক্ষ কোনো ভাষিক-উৎপাদন পদ্ধতি নেই, যদিও মতাদর্শিকতা সব সময় সরাসরি দেখা নাও দিতে পারে। এমনকি বিজ্ঞানের ভাষাও মতাদর্শিকতায় জারিত হতে পারে। সেই মতাদর্শিকতা হতে পারে নৈর্ব্যক্তিকতা ও বস্তুনিষ্ঠতা (বা নৈর্ব্যক্তিকতা ও বস্তুনিষ্ঠতার ভান)। এমনকি ‘বিজ্ঞানের আপাত-নিরপেক্ষ ভাষা পুঁজিবাদী মুক্তবাজার এবং পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শকে সমর্থন জোগাতে পারে’, যে-কথাটা জোর দিয়েই বলেছেন ব্রিটিশ মার্কসবাদী ভূগোলবিদ ডেভিড হারভি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘জাস্টিস, নেচার এন্ড দ্যা জিয়োগ্রাফি অব ডিফারেন্স’-এ। এখানে গণিতের ভাষা নিয়েও দু-একটা কথা বলে নেয়া যায়। সেই ১৯৯৭ সালে আর্থার বি. পাউয়েল এবং ম্যারিলিন ফ্র্যাংকেস্টাইন-এর যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘এথনোম্যাথেম্যাটিকস্’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধ-সংকলন। এখানে প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ গণিতের ভাষার ও পদ্ধতির নিরপেক্ষতাকে মিথ হিসেবে প্রমাণ করে তাকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং গাণিতিক ভাষার মতাদর্শিক অভিক্ষেপকে বিভিন্ন অনুষঙ্গে ও অনুপুঙ্খে উন্মোচনও করেছে বটে। প্রবন্ধগুলো বিশেষভাবে জোর দিয়েছে গাণিতিক ভাষার ইউরোপকেন্দ্রিকতার ওপর। এবারে ওই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত প্রথম প্রবন্ধ থেকে গণিতবিদ দ্য’ অ্যাম্ব্রোসিও-এর একটি উক্তি : ‘আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আধুনিক বিজ্ঞানের, বিশেষত গণিত ও প্রযুক্তির, সঙ্গে গভীর সম্পর্কে ও সহযোগিতায় উপনিবেশবাদ ক্রমাগত পোক্ত হয়েছে।’

১৩.

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ভাষার মতাদর্শিকতা রয়েছে। আন্তোনিও গ্রামসির সুবাদে আবার আমরা এও জেনেছি যে, যাকে ‘হেজিমনি’ বলা হয়, তা আসলে সম্মতি আদায়ের মাধ্যমে জারি-রাখা মতাদর্শিক আধিপত্য। এই দুটি ধারণা ও তাদের সম্পর্ক বিবেচনায় রাখলে এও বলা যাবে যে, ‘হেজিমনি’ ভাষিকভাবে সক্রিয় হয় এবং ভাষার ভেতর দিয়েই সে এমনকি মগজ-ধোলাইও করতে পারে। পুঁজিবাদী বিশ্বে আজ বিজ্ঞাপনের বিস্ফোরণ যে ভাষিক সাম্রাজ্য তৈরি করেছে, তার কবলে পড়ে চৈতন্য নিজেই ভোঁতা হতে থাকে এমন মাত্রায় যে, একটি বিষয়ের সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ক, কিংবা সাধারণের সঙ্গে নির্দিষ্টের সম্পর্ক, ধরতে গিয়ে অনেকেরই চিন্তা হাঁসফাঁস করতে থাকে কিংবা পুরোপুরি ব্যর্থও হয়। আমরা পুঁজির যুগে বাস করি বলেই একই সঙ্গে ভাষার, চিন্তার ও সম্পর্কের ‘শর্ট সার্কিটিং’-এর যুগেও বাস করি। সে কারণেই তো ধরতে পারি না মোবাইল ফোনে কথা বলার সঙ্গে বাংলাদেশের কৃষকের রক্ত-ঝরার সম্পর্ক কি।

১৪.

আগেই বলা হয়েছে যে, বিশুদ্ধ ভাষা বলে কিছু নেই। ভাষাকে আমরা সামাজিক জীবনের বিভিন্ন মুহূর্ত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারি না, যদিও পুঁজির প্রভাবে বিশেষ বিশেষ ভাষা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি করতে পারে। তবে এই সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ভাষা বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নিজেই সামাজিক, কেননা ওই বিচ্ছিন্নতা সমাজের ভেতরেই একটি সামাজিক ঘটনা হিসেবে উপস্থিত থাকে। এও সত্য যে, ভাষাকে একটি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং সক্রিয় ‘যোগাযোগের চিহ্নব্যবস্থা’ হিসেবে তত্ত্বায়িত করা সম্ভব হলেও ভাষা থেকে তার নির্দিষ্ট ব্যবহারকারীকে বিচ্ছিন্ন করা অনেক ক্ষেত্রেই প্রায় অসম্ভব। ব্যক্তি/কর্তাসত্তা ভাষা ব্যবহার করে, যেমন ভাষা ব্যবহার করে একটি কমিউনিটি। অবশ্য মানুষ নিজেই ভাষা তৈরি করে, ভাষা বদলায়, ভাষাকে ধ্বংস করে। আবার ঐতিহাসিকভাবে উৎপাদিত ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ভাষা নিজেই মানুষের ওপর তার ক্ষমতা দেখায় বা কর্তৃত্ব ফলায়। এ কারণেই একাধিক তাত্ত্বিক ‘ভাষার কয়েদখানা’র রূপকটা চালু রাখেন। তাহলে আমরা ভাষা ব্যবহার করি, নাকি ভাষাই আমাদের ব্যবহার করে? আমরা কথা বলি, নাকি ‘কথা’ আমাদের বলে? দুটো প্রশ্নকেই রেটোরিক্যাল’ প্রশ্ন হিসেবে নেয়া যেতে পারে। ভাষা আমাদেরকে যেমন ব্যবহার করে, তেমনি আমরা ভাষাকেও ব্যবহার করি। এই ‘ডায়ালেকটিকস’ এও বলে দেয় যে, মানুষ ও ভাষা কোনোটাই চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে সার্বভৌম নয়।

১৫.

আফ্রিকী লেখক-তাত্ত্বিক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো যথার্থই বলেন : ‘ভাষা একই সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম ও সংস্কৃতির বাহন।’ আন্তোনিও গ্রামসি আগেই বলেছেন, ‘প্রতিটি ভাষাই একটি বিশ্ববীক্ষার ও সংস্কৃতির উপাদান ধারন করে থাকে।’ তাই ভাষা বদলানোর সঙ্গে সাংস্কৃতিক রূপান্তরের যোগাযোগ আছে, যদিও সবসময় এ যোগাযোগ যান্ত্রিক নয়।

১৬.

ভাষা নিজেই আবার সংস্কৃতির রূপ নিতে পারে। কেননা ভাষা হতে পারে একটি জনপদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সমষ্টিগত স্মৃতির সঞ্চয়ক্ষেত্র। এই ইঙ্গিতটা এসেছে নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর কাছ থেকেই। হ্যাঁ, সংস্কৃতি থেকে ভাষা প্রায় অবিচ্ছেদ্য । কেননা ভাষা ওই সংস্কৃতির জন্ম, বৃদ্ধি, বিকাশ ও প্রকাশকে সম্ভব করে তোলে। যেমন ভাষা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সংস্কৃতির প্রবহকেও সম্ভব করে তোলে।

১৭.

ভাষা একই সঙ্গে দৈহিক ও মানসিক কাজ, যা আবার বিভিন্ন কাজে লাগে।

১৮.

ভাষা থাকে বলেই ভাষার সৃজনশীল ব্যবহারও থাকে। ভাষা ব্যকরণকে অনুসরণ করে না; বরং ব্যকরণ ভাষাকে অনুসরণ করে। আবার ভাষা যেমন যোগাযোগের সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা, তেমনি ওই ব্যবস্থার বাইরেও ভাষা থাকে এক ধরনের সামাজিকতা নিয়েই। নৈঃশব্দ্যও এক ধরনের ভাষা বটে।

১৯.

ভাষায় সময় ও স্পেস ভূমিকা রাখে এবং লুকিয়ে থাকে, যেমন শ্রেণী, লিঙ্গ, বর্ণ, জাতি ইত্যাদি ভাষার চেহারা ও চরিত্রকে বিভিন্ন ভাবেই প্রভাবিত করে।

২০.

ভাষা হতে পারে রক্তাক্ত লড়াইয়ের ময়দান, যেমন ভাষা হতে পারে ব্যকরণের বিরুদ্ধেও লড়াইয়ের ক্ষেত্র। আবার ভাষা হতে পারে শ্রেণী-সংগ্রাম, বর্ণ-সংগ্রাম, জেন্ডার-সংগ্রাম এবং জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের এলাকা। লড়াই নিজেই হয়ে উঠতে পারে বাস্তব জীবনের ভাষা।

২১.

ভাষা কোন কিছুকে যেমন প্রকাশ করতে পারে, তেমনি তাকে প্রচ্ছন্নও করে।

২২.

ভাষা নিয়ে শেষ কথা থাকে না বলেই ভাষা নিয়ে কথা থাকে।

২৩.

কবিতায় ভাষা কী চেহারা নেয়? বা ভাষায় কবিতার চেহারা কেমন দেখায়? প্রশ্নগুলো ইতিহাসের ভেতরেই ঝুলে আছে অনেক, অনেক সময় ধরে। কিন্তু কোন একক, নির্দিষ্ট উত্তর মেলেনি। তবে কবিদের একটা বড়ো দল ভাষা নিয়ে দারুণ একটানা অস্বস্তিতে ভুগেছেন। ভাষাকে নাই করে দেয়ার, বেমালুম গায়েব করে দেওয়ার, আয়োজন চলেছে। সেই ভাষার যা বাস্তবজগতের ভারে ভারাক্রান্ত থাকে, যা নির্দিষ্ট অর্থ-পুনরুৎপাদনে তৎপর থাকে। ফরাসী কবি স্তেফান মালার্মের কথা মনে পড়ে। তাঁর কাব্যস্বভাব নিয়ে সচরাচর যে সব ধারনা জারি আছে তার মধ্যে একটি হল এই যে, তিনি কবিতাকে চূড়ান্ত সাঙ্গীতিকতা দিতে চেয়েছিলেন। এমনকি কবিতার ভাষাকে সঙ্গীতের ভাষায় উন্নীত করতে চেয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, তার কবিতায় থাকে চিহ্নের ওপারে চিহ্ন, যা একইসঙ্গে উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির ‘ডায়ালেকটিকস’-এ সবসময় ক্রীড়াময়। এও বলা হয়ে থাকে, মালার্মীয় ভাষায় রয়েছে অন্তর্গত ধ্বনিনির্ভর নৈঃশব্দ্য যা অনুবাদে আসে না। তারপরও চলে অনুবাদের আয়োজন। অনুবাদে যা নাই হয়ে যায় বলে আগেভাগে ধরে নেওয়া হয় তাও থাকে। ওই ‘নাই’ থাকে কবিতার ছায়া বা অনুষঙ্গ হয়ে। আবার ওই নাই-এর থাকা বা না-থাকা নিয়ে থাকে অনুবাদকের অস্বস্তি, যার ইঙ্গিত দিয়েছেন জর্মন মার্কসবাদী সংস্কৃতি-তাত্ত্বিক ওয়ালটার বেনজামিন। এ অস্বস্তি ভাষা নিয়েও অস্বস্তি। মালার্মে নিজেও ভাষা নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগেছেন। ওই অস্বস্তি অতিক্রম করার জন্য জন্য এমনকি নগ্ন নেতির ধারনাকে সামনে এনে ভাষার তাবৎ বাস্তবতাকে যেন ঝেড়ে ফেলে তিনি বিশুদ্ধ ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। কিন্তু তারপরও ভাব ও বস্তুর বিভাজন-রেখা হুট করে এঁকে ফেলা যায় না। কবিতার ভাষা ও সঙ্গীতের ভাষার আপেক্ষিক সার্বভৌমত্বকে মেনে নিয়েও বলা যাবে যে, এই ভাষাও বস্তজগতের ভারে ভারাক্রান্ত থাকে। আবার যেমন ভাবের ভারে ভারাক্রান্ত থাকে বস্তজগত নিজেই।

২৪.

ভাষা নিয়ে স্তেফান মালার্মের অস্বস্তির কথা বলেছি। এই অস্বস্তি আবার ভাব ও বস্তুর মধ্যে জোর-করে-তোলা-দেয়াল নিয়েও। এসব বিষয় লক্ষ্য করি মালার্মের একাধিক গদ্য কবিতায়। তাই আমার তর্জমায় মালার্মের একটি গদ্য কবিতার দিকে তাকানো যাক।

প্রতিষঙ্গের প্রেতাত্মা

তোমার ঠোঁটে গেয়েছিল গান নাম-না-জানা শব্দরা? এক অসম্ভব বাকধারার অভিশপ্ত টুকরো?

ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে আসি, কোন এক বাদ্যযন্ত্রের তারের ওপর পিছলে-পড়া পালকের মতো অনুভব সঙ্গে নিয়ে, বিনম্র ও বহতা, যার স্থান করে নেয় একটি কণ্ঠস্বর, ধীরে ধীরে নেমে-যাওয়া ধ্বনিতরঙ্গায়িত শব্দের উচ্চারণে: ‘লা পেনালতিয়েম এ মখত্’ এবং শব্দগুলো উচ্চারিত হয় এমনভাবে যেন পঙ্ক্তির অন্তে ঝুলে আছে ‘লা পেনালতিয়েম’, আর ‘এ মখত্’ সেই অদৃষ্টময় বর্ণমালা, অর্থের নাক্ষত্রিক নৈঃশব্দ্যে। পরে কয়েক পা ফেলতেই ‘নাল’ ধ্বনিতে অনুভব করি বাদ্যযন্ত্রের একটি টানটান তীর। সে ছিল বিস্মরণে আর মহীয়ান স্মৃতি নিশ্চিত তাকে ছুঁয়ে গেছে পালক কিংবা পত্র কিংবা তালু দিয়ে। রহস্যের নকসার ওপর আঙুল আমার, মৃদু হেসে আমি প্রার্থনা করলাম এক ভিন্ন অনুধ্যানের বিষয়ের জন্য, বুদ্ধিবৃত্তিক আকাঙ্খায়। ছিঁড়ে-যাওয়া পালক কিংবা পাতার প্রাক্তন পতন থেকে তখন ফিরে এলো বাকধারা, নিশ্চিত, আগের মতোই। এখন থেকে তাকে শোনা যাবে কণ্ঠস্বরের উচ্চারণে ততোক্ষণ ধরে যতোক্ষণ না সে অবশেষে নিজের উচ্চারণে জানান-দেয়া উপস্থিতিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে। শুধুমাত্র একটি বোধে আর তৃপ্ত না থেকে আমি তাকে মনে মনে মিত্রাক্ষরের মতো পাঠ করতে থাকি। আর একবার পরখহেতু আমার বয়ানের সঙ্গে মিলিয়ে উচ্চারণ করি উঁচু গলায়। শীঘ্রি তাকে এমনভাবে উচ্চারণ করতে থাকি যে, ‘পেনালতিয়েম’-এর পর একটি যতির নৈঃশব্দ্য থেকে যায়: কী বিষন্ন আনন্দ! ‘পেনালতিয়েম’: বাদ্যযন্ত্রের তার, ‘নাল’ ধ্বনির বিস্মরণে প্রসারিত ও তীব্র, ভেঙে পড়ল নিশ্চিত, আর আমি এক ধরনের প্রার্থনা জুড়ে দিলাম : ‘এ মখত’। আমার প্রিয় সব ভাবনায় ফিরে আসার চেষ্টা না থামিয়েই দাবি জানাই নিজেকে শান্ত করার, এই ভেবে যে, ‘পেনালতিয়েম’ নিশ্চিতভাবে একটি আভিধানিক শব্দ যার অর্থ: একটি শব্দের অন্তিম অক্ষরের প্রাগাক্ষর। সেই আমার ভাষার কাজ শেষে খুব সাধারণভাবেই শব্দটি দিনের পর দিন আমার মহীয়ান কাব্যগুণের ওপর আছড়ে পড়ে, বাধা পেয়ে সে ফুঁপিয়ে কাঁদে প্রতিদিন। এমনকি থামতে-না-জানা হাঁ-জানান-দেওয়া ভঙির ক্ষিপ্রতায় রূপ-নেয়া ধ্বনির জমাট ভার আর মিথ্যার প্রতিভাস হয়ে উঠেছিল যন্ত্রণার কারণ। দুশ্চিন্তায় আমি বাক্যাংশের ভেতর থেকে বিষণ্ণ ধরনের শব্দগুলোকে আমার ঠোঁটের চারদিকে হেঁটে চলার সুযোগ দিলাম। আর আমি হাঁটতে লাগলাম। কণ্ঠে আমার সমবেদনা-জাগানিয়া গুঞ্জন : ‘উপাধাটি মৃত, সম্পূর্ণ মৃত, রে দুর্ভাগা উপাধা’। আর ভাবতে থাকলাম, আমার অস্বস্তিকে এভাবে আমি সান্তনা দিতে পারি, লুকিয়ে-থাকা প্রত্যাশাও ছিল তাকে দাফন করার সাঙ্গীতিক বিস্তারে যখন কী এক আতঙ্কে, কী এক সহজিয়া কিন্তু অস্বস্তিকর সম্মোহনে অনুভব করলাম যে, দোকানের জানালায় ছায়া-ফেলা আমার হাতখানা কাউকে জড়িয়ে ধরবে বলে নিচে নেমে যাচ্ছে, তখনই অধিকারে এলো সেই কণ্ঠস্বর (যা শুনেছিলাম গোড়াতেই, নিশ্চিতভাবে যা ছিল এক ও একমাত্র।)

কিন্তু যে-মুহূর্তে পরাপ্রাকৃতের প্রতিকারহীন প্রবেশের ভেতর-পথ স্পষ্ট হল এবং যন্ত্রনার কুচকাওয়াজ শুরু হল, যার নিচে কষ্টে মোচড় খেতো আমার এক সময়ের রাজকীয় সংবেদন, সেই সময় চোখ তুলে দেখলাম আমি হাঁটছিলাম প্রাচীন দ্রব্য-ব্যবসায়ীদের রাস্তা ধরে; দাঁড়িয়েছিলাম এক বেহালানির্মাতার দোকানের সামনে। বিক্রির জন্য সেখানে ছিল দেয়ালে ঝুলে-থাকা পুরনো বাদ্যযন্ত্র এবং মেঝেতে পড়ে-থাকা কিছু হলুদ তালপত্র এবং ছায়ার ভেতরে লুকিয়ে-থাকা প্রাচিন পাখিদের পালক। অপ্রকৃতিস্থের মতো আমি পালিয়ে গেলাম। সম্ভবত দুর্জ্ঞেয় ‘পেনালতিয়েম’-এর জন্য আমার এই অদৃষ্টময় বিলাপ।

[‘লা পেনালতিয়েম এ মখত্’ একটি ফরাসি বাক্য, বাংলায় যার ভাষান্তরিত রূপ হতে পারে এমন: উপধাটি মৃত।]

২৫.

আমার তর্জমায় স্তেফান মালার্মের আরেকটি গদ্য কবিতার দিকে তাকাতে পারি। এ কবিতাতেও ভাষা নিয়ে মালার্মের অস্বস্তি লক্ষ্য করি। এও লক্ষ্য করি যে, ভাব ও বস্তুর টেনশান কবিতার ভাষাকে জড়িয়ে আছে।

ভবিষ্যের দিকে

বুড়িয়ে যাওয়ায় মরে-যাচ্ছে-যাচ্ছে এমন এক পৃথিবীর ঊর্ধ্বে মেঘেদের সাথে হয়তো বিদায় নেবে ফ্যাকাশে আকাশ এক। সূর্যের কিরণ আর জল দিয়ে ঢেকে-রাখা দিগন্তের ওপর ঘুমিয়ে-পড়া নদীর ভেতর সূর্যাস্তগুলোর ছেঁড়া-ছেঁড়া গোলাপী ক্ষয়ের চিহ্ন সব মিলিয়ে যায়। একঘেঁয়ে সময়ের ভারে গাছগাছালি সব অবসন্ন। আর তাদের শাদা-হয়ে-যাওয়া পাতাগুলোর নিচে পথের নয় বরঞ্চ সময়ের ধুলোবালিতে ক্যাম্বিস তাঁবু নিয়ে জেগে ওঠে অতীত সব চিহ্নের সঙ : গোধূলির অপেক্ষায় থাকে অনেক গ্যাসবাতি, আবারও জিইয়ে তোলে অসুখী ভিড়ের সেই সব মুখ আর অবিনাশী রুগ্নতা আর বহু শতকের জমা পাপ তাদের জয় করে নেয়, যাদের কিনারে থাকে ভয়াবহ দুঃসঙ্গী সব, এক অমাঙ্গলিক ফলের ভারে ভারাক্রান্ত। পৃথিবী বিলীন হবে এই ফলের সঙ্গে। সমস্ত চোখের পীড়িত নৈঃশব্দে ডুবে থাকে স্থান, যে নৈঃশব্দ্য সূর্যের কাছে মিনতি জানায়, যে সূর্য একটি ধ্বনির হতাশায় ডুব দেয় জলে। সঙ কথা কয় নিচু স্বরে: ‘ভেতরে প্রদর্শণী দেখাবে বলে তোমাকে আমোদিত করার এমন কোন চিহ্ন নেই। কারণ এখন এমন কোন চিত্রকর নেই যে আঁকতে পারে তার ক্ষীনতম প্রতিচ্ছায়া। আমি তোমাদের কাছে নিয়ে আসি সেই কবেকার জীবন্ত এক নারীকে। [যাকে সার্বভৌম বিজ্ঞান বছরগুলোতে সংরক্ষণ করে রেখেছে।]’ কিছু পাগলামি, মৌলিক ও সরল, একটি সোনালী উল্লাস ও উন্মাদনা, আমি জানিনা কী তা! যাকে সে তার চুল বলে, বুননের বৈভবে যেন সে ছড়িয়ে থাকে তার ঠোঁটের রক্ত-লাল নগ্নতায় জ্বলে-উঠা মুখের চারদিক। শূণ্যতার পোষাক খসে পড়ে, থাকে তার দেহ। অমূল্য হিরন্ময় পাথরের মতো তার চোখ সেই দৃষ্টির সমান নয়, যে দৃষ্টি উঠে আসে তার সুখময় মাংশের স্বরঃচ্ছন্দ থেকে : সেই দৃষ্টি জেগে ওঠে তার স্তনযুগল থেকে যেন তারা অনন্ত দুধের ভরাট ভান্ড, তাদের চূড়া নিশানার মতো জেগে থাকে আকাশের দিকে, বিস্মরনময় পা দিয়ে এঁকে-যাওয়া দাগের দিকে, যার দেহে থেকে যায় আদিম সমুদ্রের নুন। তাদের অসহায়, ক্লান্তিকর, রুগ্ন ও আতঙ্কিত স্ত্রীদের কথা স্মরণ করে স্বামীরা একসাথে ভিড় জমায়। তাদের বিষন্ন স্ত্রীরা দেখে নিতে চায় কৌতূহলে।

কোন এক পূর্ব-অভিশপ্ত যুগ থেকে ছাড়া-পাওয়া সেই মহীয়ান প্রাণীটির দিকে যখন সকলেই নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে, তারা আবার একে অন্যের দিকেও তাকাবে, কেউ কেউ নিরঞ্জন ঔদাসীন্যে, কেননা কী হচ্ছে তা বোঝার ক্ষমতা নেই তাদের। কিন্তু অন্যরা তাকাবে বিষণ্ণভাবে, তাদের চোখের পাতা ভিজে থাকবে সমর্পিত জলে; যখন এই সময়ের কবিদের ঘোলা চোখ উঠবে জ্বলে, তারা এগিয়ে যাবে তাদের বাতিগুলোর দিকে, মুহূর্তের জন্য হলেও একটি বিভ্রান্ত মহিমায় তাদের মস্তিষ্ক উত্তেজিত হবে উন্মাদনায়, আক্রান্ত ও আলোকিত হবে ছন্দ:ব্রহ্মে এবং ভুলে যাবে যে, তাদের অস্তিত্ব এমন এক যুগে, যে-যুগ সৌন্দর্যের চেয়েও ঢের বয়সী।


আজফার হোসেন:

তাত্ত্বিক, সমালোচক ও অ্যাক্টিভিস্ট। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আন্তঃশাস্ত্রীয় বিদ্যার অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করার পর ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি ও বিশ্বসাহিত্যে ডক্টরেট করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে ইউনিভার্সিটি অফ লিবারাল আর্টস, নর্থ সাউথ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াশিংটন স্টেট, বৌলিং গ্রিন স্টেট ও ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্য, কালচারাল স্টাডিজ এবং এথনিক স্টাডিজ পড়িয়েছেন। ভাষা, সাহিত্য, সাহিত্যতত্ত্ব, সংস্কৃতি, দর্শন, ইতিহাস, রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং রাজনীতি-সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তাঁর কয়েক শ' প্রবন্ধ ও নিবন্ধ দেশে ও বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি ভাষা থেকে তাঁর ইংরেজি অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ-এর সহ-সভাপতি তিনি। পাশাপাশি বিপ্লবী গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে The Wor(l)d in Question: Essays in Political Economy and Cultural Politics (২০০৮), দর্শনাখ্যান (২০১৯), পাঠ: শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের রাজনীতি (২০২২), চিহ্ন ভাসে অবশেষে (২০২৩)।