আজফার হোসেনের নিরীক্ষামূলক ভ্রমণাখ্যান 'চিহ্ন ভাসে অবশেষে'

আজফার হোসেনের নিরীক্ষামূলক ভ্রমণাখ্যান 'চিহ্ন ভাসে অবশেষে'


আজফার হোসেনের এই নিরীক্ষামূলক ভ্রমণাখ্যানের ঝলমলে ও স্পন্দিত গদ্যে আছে দেহের সঙ্গে মনেরও ভ্রমণ, আছে কিছু মানুষের ও স্থানের গল্প, আছে লেখকের নিজ জীবনের কিছু গল্প, আছে গল্প নিয়ে গল্প, আছে বয়ান নিয়ে বয়ান আর আছে লঘু চালে তত্ত্বালোচনা ও সাহিত্য সমালোচনা। ভ্রমণপাগল ভবঘুরে মনের পথচলার বৃত্তান্তে আরো আছে সময়, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কিছু রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভাবনা, যেগুলো প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে থাকে। বইটির সৃষ্টিশীল পরিসরে আর মিশ্র ফর্মের অনিবার্য টানে জড়ো হয়েছে চিঠি, স্বগতোক্তি, স্মৃতিচারণ, চিন্তাচিত্র, লেখকের তর্জমায় চীনা ও হিস্পানি কবিতা এবং জীবনভ্রমণের বিচিত্র ছন্দঃস্পন্দে ভেসে বেড়ানো বিভিন্ন চিহ্ন নিয়ে গদ্য-কবিতাসহ আরো কিছু অনুষঙ্গ। বইটি ভ্রমণ, ভাষা আর ভাবনাকে অবিভাজ্য করে বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে।


পুণ্ড্র প্রকাশন:

https://www.facebook.com/pundroprokash

রকমারি ডট কম:

https://www.rokomari.com/book/366087/cinho-bhase-oboshese

Hand to Hand Book Shop:

https://handtohandbookshop.com/book/চিহ্ন-ভাসে-অবশেষে


তবে তুমুলভাবে উদযাপিত ফরাসি তাত্ত্বিক মিশেল ফুকোর ক্ষমতাতন্ত্র পড়াতে গেলে-যদিও ফুকো নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন আছে-আমার এই ঘটনার কথা কখনও কখনও ছাত্রছাত্রীদের বলি এইটা বুঝিয়ে যে, প্রতিষ্ঠান আর প্রতিষ্ঠিতরা ক্ষমতাবলে জ্ঞান উৎপাদন করে এবং তাকে জায়েজ করে, আর কেবল নিছক জ্ঞানই ক্ষমতার উৎস নয়। 

- চিহ্ন ভাসে অবশেষে || আজফার হোসেন ||


পুঁজির ফাটকাবাজিতে বৃদ্ধি, বিস্তার আর বৈপরীত্য তো নগরসভ্যতার অন্যতম মন্ত্র-সারা পৃথিবী জুড়ে নগরগুলো বাড়তে থাকে, কেবল বাড়তেই থাকে, যেমন বেড়েছে আমাদের ঢাকা। 

- চিহ্ন ভাসে অবশেষে || আজফার হোসেন ||


পরাবাস্তববাদী কায়দায় তাঁদের প্রসঙ্গগুলো আকস্মিক মোড় নেয়া শুরু করে। আর তাঁদের থামায়ই বা কে? মুহূর্তেই বুঝে নিলাম, তাঁর সঙ্গে কোনো সুস্থ তর্ক মোটেই এগুবে না। এঁরা বলতে ভালোবাসেন, শুনতে নয়। 

- চিহ্ন ভাসে অবশেষে || আজফার হোসেন ||


কোনো জবাব দেয়ার চেষ্টা করলেই তিনি বারবার এক কথাই পৌনঃপুনিক দশমিকের মতো উচ্চারণ করেন: 'আহ! আমাকে তো কথা বলতে দিচ্ছেন না!' অদ্ভুত লাগলো! কথার খই ফুটিয়ে যাচ্ছেন তিনি, অথচ আমি কোনো কথা বলতে গেলেই সেটা বেয়াদবি বিবেচিত হচ্ছে। একেই বলে বাকযন্ত্রের আধিপত্য! আর অন্যদিকে আমার শাসিত শ্রুতিযন্ত্রটা অনেকটা শোষিত শ্রমিকের মতোই শ্রম দিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মজুরি পাচ্ছে না। 

- চিহ্ন ভাসে অবশেষে || আজফার হোসেন ||


কিন্তু আমাদের ওইসব 'ফ্যাশানেবল অ্যাকটিভিস্ট' যেভাবে আকৃষ্ট হন, তাতে মনে হয় যে, মার্কসকে আঘাত করলেই শুলামিথ-প্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব।

কিন্তু এঁদের খেয়াল করা দরকার যে, লেনিনই, মার্কসের অনুসরণে, অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, নারী যদি সম্পূর্ণ স্বাধীন না হন, প্রোলেতারিয়েতের পূর্ণ স্বাধীনতা কখনই আসতে পারে না; কেননা নির্যাতন ও শোষণের প্রক্রিয়ায় নারীই হচ্ছে সবচাইতে বড় প্রোলেতারিয়েত ও সর্বহারা। 

- চিহ্ন ভাসে অবশেষে || আজফার হোসেন ||


বাংলাদেশে নারী-শোষণের প্রক্রিয়া ও চেহারাটাই এমন যে, এখানে গ্রামের দরিদ্র নারীকে সর্বহারাই তো বলতে হয়। এই সর্বহারা অসংখ্য নেই-এর সমষ্টি: নেই দিয়েই তো নারীর ওপর শোষণের চেহারাটাকে দেখে নেয়া যায়। যেমন, নারীর স্বাতন্ত্র্য নেই, নাম নেই, পরিচয় নেই, এমনকি তার দেহটাও নেই, যে-দেহটা আসলে থাকে শোষকের দখলে-পুরুষ ও পুঁজির দখলে। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক আর্থ-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাই এই নেই-কে বিভিন্নভাবে উৎপাদনও সংহত ক'রে চলেছে; তাই মুক্তির যুদ্ধটা হতে পারে এই 'নেই'-এর বিরুদ্ধে; যুদ্ধটা আসলে নেই-কে নেই করার ভেতরেই। 

- চিহ্ন ভাসে অবশেষে || আজফার হোসেন ||


যুক্তির সঙ্গে যুক্ত হওয়া চাই অনুভব ও আবেগ, তাদের সঙ্গে আবার যুক্ত হওয়া চাই স্বজ্ঞা ও প্রজ্ঞা, এবং এভাবে মিলে-মিশে মানুষের দেখার চোখ ও বোঝার মন আরো শক্তিশালী হতে পারে। 

- চিহ্ন ভাসে অবশেষে || আজফার হোসেন ||


যখন কবি বলেন: 'আমি ওইসব নেড়ি কুত্তার লেজ এবার ঠিক করে দেবো', তখন যদি কেউ প্রশ্ন করেন: 'নেড়ি কুত্তাদের নাম বলা হলো না কেন?', তাহলে ধরে নিতে হবে সেই কবি একটি অসাহিত্যিক প্রশ্নের মুখোমুখি। সে ধরনের প্রশ্ন করার অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না নিশ্চয়ই, কিন্তু প্রশ্ন যদি নিজেই তর্জনী-নির্দেশের আকারে সাহিত্যের ফর্মের স্বাধীনতার ওপর চড়াও হয়, তাহলে সেখানে জন্ম নিতে পারে সমালোচনার ফ্যাসিজম্।

 - চিহ্ন ভাসে অবশেষে || আজফার হোসেন ||



ধরা যাক, রহিম ডাকাতি করেছে। কিন্তু সমাজে রহিমের চেয়ে বড় বড় ডাকাত তো ডাকাতি করে চলেছে। তাই বলে রহিম যে ডাকাত নয়, সেটা বলা যাবে? তাই বলে রহিমের ডাকাতিকেই আমরা খারিজ ক'রে দেবো? এই কাজটা হয়তো তাঁরাই করবেন, যাঁরা র‍্যাশনালিটিকে পুজো ক'রে তাকে সুযোগ-সুবিধা লুটবার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। সাব্বাশ র‍্যাশনালিটি! 

- চিহ্ন ভাসে অবশেষে || আজফার হোসেন ||


'অন্ধ' বলা হচ্ছে এই কারণে যে, এঁরা যখন কাউকে খারিজ করেন, তাকে সম্পূর্ণ দেখে-শুনেও খারিজ করেন না; যাকে আবার ভক্তি করেন, তাকেও সম্পূর্ণ অবলোকন করে বুঝে-শুনে ভক্তি করেন না। হায়রে অন্ধ অবলোকনের চোখ! কিন্তু চোখ যখন খুলে যায়, তখন যে দু'টোই খোলে, তাও নয়। খোলা থাকে একটাই। আর এই এক চোখের অবলোকনে কেউ হয়ে উঠেন প্রশ্নাতীত ভগবান, কেউ হয় প্রশ্নবিদ্ধ শয়তান। আমাদের সমালোচনার সংস্কৃতিতে এই এক চোখে, কিংবা চোখ বন্ধ ক'রে, অবলোকনের প্রপঞ্চ ও প্রবণতা দুর্ভাগ্যজনকভাবেই শনাক্তযোগ্য। ফতোয়াবাজির উৎস যে অন্ধ অবলোকন, তার অনেক প্রমাণই তো আমরা পেতে শুরু করেছি। 

- চিহ্ন ভাসে অবশেষে || আজফার হোসেন ||


বলাই বাহুল্য, যা ডিকনস্ট্রাকশান নয়, তাকে ডিকনস্ট্রাকশান বলা অনেকটা আমকে কাঁঠাল বলার মতো। আর যিনি আমকে কাঁঠাল বলেন, তিনি আমও চেনেন না, কাঁঠালও চেনেন না। এই ফতোয়াবাজের দশা বোধকরি সে রকমই। যা ডিকনস্ট্রাকশান নয়, তাকে ডিকনস্ট্রাকশান বলে চালিয়ে দেওয়ার ভেতরে এই ফতোয়াবাজের 'মুর্খ উচ্ছ্বাস'-ই কী ধরা পড়ে না? 

- চিহ্ন ভাসে অবশেষে || আজফার হোসেন ||



কোনো বিষয়কে বাতিল করতে হলে বিষয়টি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকা চাই। কিন্তু জ্ঞান তো আপনাআপনি আসে না, অবলোকনের চোখও তো আপনাআপনি খোলে না; সে জন্যে চাই শ্রম ও প্রেম। বলাই বাহুল্য, শ্রমহীন ও প্রেমহীন লোক নিমেষেই কারো চোখ উপড়ে নিতে পারে, কিন্তু সৃজনশীল হতে পারে না। 

- চিহ্ন ভাসে অবশেষে || আজফার হোসেন ||


মুহূর্তগুলো তো ছিঁচকে পকেটমার! সময়ের পকেট কেটে-কেটে ওরা ভেগে যায়, আচমকা এ গলি ও গলি ধরে। তা তো যাবেই, কিন্তু মাঝে মাঝে ফিরেও আসে। যখন ফিরে আসে, তখন তো পকেটমারকে আর ঘা দেই না, বরং তাকে দু'দণ্ড বসতে বলি। 

- চিহ্ন ভাসে অবশেষে || আজফার হোসেন ||


আজফার হোসেন:

তাত্ত্বিক, সমালোচক ও অ্যাক্টিভিস্ট। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আন্তঃশাস্ত্রীয় বিদ্যার অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করার পর ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি ও বিশ্বসাহিত্যে ডক্টরেট করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে ইউনিভার্সিটি অফ লিবারাল আর্টস, নর্থ সাউথ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াশিংটন স্টেট, বৌলিং গ্রিন স্টেট ও ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্য, কালচারাল স্টাডিজ এবং এথনিক স্টাডিজ পড়িয়েছেন। ভাষা, সাহিত্য, সাহিত্যতত্ত্ব, সংস্কৃতি, দর্শন, ইতিহাস, রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং রাজনীতি-সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তাঁর কয়েক শ' প্রবন্ধ ও নিবন্ধ দেশে ও বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি ভাষা থেকে তাঁর ইংরেজি অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ-এর সহ-সভাপতি তিনি। পাশাপাশি বিপ্লবী গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে The Wor(l)d in Question: Essays in Political Economy and Cultural Politics (২০০৮), দর্শনাখ্যান (২০১৯), পাঠ: শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের রাজনীতি (২০২২), চিহ্ন ভাসে অবশেষে (২০২৩)।