যশোর হত্যাকাণ্ডের ২৫ বছর পূর্তিতে উদীচীর প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ

যশোর হত্যাকাণ্ডের ২৫ বছর পূর্তিতে উদীচীর প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ

যশোরে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে নৃশংস বোমা হামলার কুশীলবরা এখনও আগের মতোই সক্রিয়। তাদের ষড়যন্ত্র থামেনি। বরং আরো বিস্তৃত হয়েছে। ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মাধ্যমে সেই অন্ধকারের অপশক্তিকে প্রতিরোধ করা হবে। যশোর হত্যাকাণ্ডের ২৫ বছর পূর্তিতে উদীচী আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ প্রত্যয় জানিয়েছেন বক্তারা। যশোর হত্যাকাণ্ডের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ০৬ মার্চ  ২০২৪ বুধবার উদীচী চত্বরে (১৪/২, তোপখানা রোড-- জাতীয় প্রেসক্লাবের বিপরীতে) আয়োজিত হয় প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ। সমাবেশের শুরুতেই যশোরে শহিদদের স্মরণে স্থাপিত অস্থায়ী বেদিতে শ্রদ্ধা জানান উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ, ঢাকা মহানগর সংসদ, গেন্ডারিয়া শাখা, মোহাম্মদপুর শাখা, উত্তরা শাখা, ধানমন্ডি শাখা, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এরপর দুটি সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা। তারা পরিবেশন করেন-- "যতবার ঝরবে আমাদের রক্ত, সংগ্রাম হবে ততবার" এবং "লাখো লাখো হাত ভেঙেছে আজকে" এই গান দুটি। এরপর শহিদদের স্মরণে আলোক প্রজ্বালন করা হয়।


এরপর উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান-এর সভাপতিত্বে শুরু হয় আলোচনা পর্ব। এ পর্বে বক্তব্য রাখেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম, যশোর জেলা সংসদের কার্যনির্বাহী সদস্য লুবনা আফরোজ পাপ্পু, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি এবং বোমা হামলার সময় উদীচীর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা মাহমুদ সেলিম, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি শিবাণী ভট্টাচার্য্য, হাবিবুল আলম, প্রবীর সরদার, জামসেদ আনোয়ার তপন, ইকরামুল কবির ইন্টু এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষ। এ পর্বটি সঞ্চালনা করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক ইকবালুল হক খান।


সমাবেশে উদীচীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, ২৫ বছর ধরে উদীচী বারবার দাবি জানিয়ে গেছে যশোর হত্যাকাণ্ডের বিচার করার জন্য। কিন্তু কোনকিছুতেই কোন লাভ হয়নি। এই বিচার না হওয়ার জন্য রাষ্ট্রের সীমাহীন ব্যর্থতাকে দায়ী করেন তিনি। রাষ্ট্র এই বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই ১৯৯৯ সালের পর একে একে কমিউনিস্ট পার্টি, ছায়ানট, সারাদেশের সিনেমা হল, আওয়ামী লীগের জনসভাসহ বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। অমিত রঞ্জন দে আরো বলেন, একথা জোর গলায় বলা যায় যে, যদি সঠিক সময়ে উদীচীর উপর বোমা হামলার সুষ্ঠু বিচার সম্পন্ন করা যেতো, তাহলে এদেশের মাটিতে আর কোন বোমা হামলার ঘটনা ঘটতো না। শুধু তাই নয়, যশোর হত্যাকাণ্ডের কুশীলবরা নিষ্ক্রিয় তো হয়ই নি, বরং আরো বেশি সক্রিয় হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের ষড়যন্ত্রের জাল আরো বেশি বিস্তৃত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।


সমাবেশে অন্য বক্তারা বলেন, সেদিনের সেই ভয়াবহ ঘটনার ২৫ বছর পরও সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে। শুধু গ্রামে-গঞ্জে নয়, শহরাঞ্চলেও এখন লোকজ সংস্কৃতির চর্চা করতে গেলে খোদ প্রশাসনের পক্ষ থেকেই নানা ধরনের বাধা দেয়া হয়। বাউল গান, যাত্রা পালা বা নাটক করতে গেলে প্রশাসনের অনুমতি নেয়ার জন্য দ্বারে দ্বারের ঘুরতে হয়। তারপরও নানা অজুহাতে সেসব অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। এ ধারা চলতে থাকলে যে ঘৃণ্য উদ্দেশ্য নিয়ে যশোর হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল সেই উদ্দেশে সফল হতে পারে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী গোষ্ঠী। তাই শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, দেশের সাংস্কৃতিক ও মানবিক ঋদ্ধির দিকে সমান মনোযোগ দেয়ার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি দাবি জানান সমাবেশের বক্তারা।


স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নশংস ও ভয়াবহ বোমা হামলারগুলোর অন্যতম যশোর বোমা হামলা। ১৯৯৯ সালের ০৬ মার্চ যশোর টাউন হল মাঠে আয়োজিত বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় ও শেষ দিনে গভীর রাতে যখন হাজারো জনতা ও সংস্কৃতিকর্মী বাংলার আবহমান সংস্কৃতির ধারক বাউল গানের সুর মূর্ছনায় বিমোহিত হয়েছিলেন, ঠিক তখনই বিকট শব্দে দুই দফা বিস্ফোরণ ঘটে মঞ্চের নিচে আগে থেকে রেখে দেয়া বোমার। ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর চালানো ওই হামলায় প্রাণ হারান নূর ইসলাম, সন্ধ্যা রানী, রামকৃষ্ণ, তপন, বাবুল সূত্রধরসহ অন্তত ১০ জন শিল্পী-কর্মী ও সাধারণ মানুষ। আহত হন দেড় শতাধিক শিল্পী-কর্মী ও সংস্কৃতিমনা সাধারণ মানুষ। মৌলবাদী অপশক্তির ঘৃণ্য হামলার শিকার সেসব সংস্কৃতি কর্মী এখনও পঙ্গুত্বের অভিশাপ বয়ে নিয়ে জীবন যাপন করছেন। এটিই ছিল স্বাধীনতার পরে এদেশের মাটিতে প্রথম প্রকাশ্যে বোমা হামলার ঘটনা।

ছবিঃ বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী